২১শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার, ভোর ৫:৫৮
শিরোনাম :
শিরোনাম :
অমর একুশে বইমেলায় মনোয়ার মোকাররমের “আগামী বসন্তে” আজ বঙ্গবন্ধু গবেষক মিল্টন বিশ্বাসের জন্মদিন কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় এপার-ওপার বাংলার লেখকগণ জবিতে ‘মধুসূদন ও বাংলা সাহিত্য’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত দীনেশচন্দ্র সেনের বৃহৎবঙ্গ, বাংলার লোককৃষ্টির যুক্ত সাধনার ঐতিহ্য আলোচনা সভার প্রধান আলোচক মিল্টন বিশ্বাস স্বর্ণপদক পাচ্ছেন কথাসাহিত্যিক নাসরীন জেবিন যারা কবিতা ভালোবাসে তারা স্বচ্ছ মানসিকতার হয় : কবি কামাল চৌধুরী ফাঁসিতলা ক্লাব ও পাঠাগারের কার্যনির্বাহী কমিটির সাথে সাংসদ মনোয়ার হোসেন চৌধুরীর শুভেচ্ছা বিনিময় ফাঁসিতলা ক্লাব ও পাঠাগারের প্রথম কার্যনির্বাহী সভা অনুষ্ঠিত ‘‘সাহিত্যে দুই মহামানব : গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু’’ বিষয়ক আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রটি অনুষ্ঠিত
নোটিশ :
Wellcome to our website...

মিল্টন বিশ্বাসের প্রেমের গল্প : নদী, নীল ও বুনোহাঁসের গল্প

রিপোর্টার
রবিবার, ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৫৮ পূর্বাহ্ন

পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পর দু’সপ্তাহ চলে গেল। সালাম ভাইকে ঈদ সংখ্যার জন্য একটা গল্প দিব বলেছি। কিন্তু গল্পটা আর লেখা হয়ে ওঠে না। ভেবেছি গল্পের বিষয় হবে প্রেম। সেদিন শুক্রবার যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টারের সামনে বসে চা পান করতে করতে এনামুল, টুটুল, রাসেল, আবিরের কাছে বিষয়টি জানালাম। জিজ্ঞেস করে জানলাম প্রেম নিয়ে গল্প লিখলে নতুনত্ব সৃষ্টি করতে ফেসবুক, হোয়াটসআপ, স্কাইপের প্রসঙ্গ আনতে হবে। আর সেক্স ছাড়া বর্তমান প্রেম কোনো প্রেম না। পরদিন হাবিবদের ক্লাশের শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম প্রেম নিয়ে গল্প লিখলে বিষয়ের নতুনত্ব কীভাবে সম্ভব? অধিকাংশই জানাল- এখন একজন একাধিক প্রেম করে। ফেসবুক চ্যাটে তিন চারজন, হোয়াটসআপে বেশি কিছু, আর যৌনতায় ধরাবাধা নিয়ম নেই। আরো কিছু আলোচনার পর একটি প্রেমের গল্প লেখা কঠিন থেকে কঠিনতর মনে হলো। তবু লিখতে হবে একটি গল্প। অনেক ভেবেচিন্তে নিচের গল্পটি পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠালাম।

২.

নীল আজকে আভিভূত হয়ে পড়েছে। তার বুকের ভেতর প্লাবন। নদীর একটানা ঢেউ? ঢাকার এয়ারপোর্ট রোড ধরে হাঁটছে সে। এই রোডটা নীলের খুব প্রিয়। বিশেষ করে বনানী ক্রসিং থেকে এয়ারপোর্টে ঢোকার মুখ পর্যন্ত রাস্তায় চলতে চলতে অনেকদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। সে ভালোবেসেছে প্রশস্ত রাস্তাটাকে; দু’ধারে সাজানো গাছের ছিমছাম অন্ধকার তার ভাল লাগে। আজকে নদীর সাথে ওর দেখা হয়নি। তবু এলোমেলো হাঁটছে সে। আদুরে বৃষ্টি ঝরছে ওর কপালে, মাথায়, চশমার কাল ফ্রেম ভেত করছে জলের কণা। নদী ওকে কথা দেয়নি। দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই; এসব সে ভাল করেই জানে। তবু সে এসেছে। এয়ারপোর্ট প্রান্তের কুড়িল ফ্লাইওভারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছিল একটা রিকশা নিয়ে ওর বিল্ডিংটা দেখে আসবে সে। যদিও কোনো ঠিকানা নেই তার কাছে। তবু বিশ্বাস তার বড় বড় দালান, লেক আর সাজানো বাড়ির কোনো একটাতে নদী আছে। একবার ভাবে আবার সিদ্ধান্ত বদলায়। কারণ নদী তাকে সতর্ক করেছে তার পরিবার জানলে ফলাফল হবে ভয়ঙ্কর। যোগাযোগ রাখাও সম্ভব হবে না তাদের। নীল অবশ্য নাছরবান্দা। তার ভেতর এখন নতুন উদ্দীপনা। অনুপ্রেরণার বুনোহাঁস তাকে খাবলে খাচ্ছে। তার আশপাশে পরিচিত মুখ থাকতে পারে এটা সে ভুলে গেছে। কেউ তাকে চিনতে পারে এটাও খেয়াল নেই।

৩.

নদীর সাথে পরিচয় তার অল্প কিছুদিনের। মে মাস গিয়ে জুন পড়েছে। ৮ মে ছিল পঁচিশে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ নদীর খুব প্রিয়। বলা যায় বেঁচে থাকার পাথেয়। সেদিন বাংলা একাডেমিতে নীল শুনছিল- ‘পুব সাগরের পার হতে কোন এলো পরবাসী’। নীলের ভবঘুরে জীবনে নদী সেই পরবাসী হয়ে এলো। রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠানের এক মুহূর্তে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল সে। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল নদীর এক কলেজ শিক্ষক যিনি নীলের পরিচিত। তারপর রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কথা আর আড্ডা। হঠাৎ বাংলা একাডেমির বটগাছটাকে নীলের মনে হলো বিস্তৃত জলরাশি। ঝাঁকে ঝাঁকে বুনোহাঁসের কলতানে মুখরিত হয়ে উঠল চারিদিক। নদী নীলের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করে সেদিন চলে গিয়েছিল। কিন্তু নীলের ভেতর তখন উথাল-পাথাল ঢেউ। নদীর রুচি, ওর চিন্তা, একান্ত করে বিশ্বকবিকে ভালোবাসা টের পেয়ে যায় নীল। সেদিন নদী চলে যাবার পর একাডেমির দেবদারু গাছগুলো জুড়ে চুটিয়ে বৃষ্টি নামে। অস্থির হাওয়া নীলকে আকাশে ভাসিয়ে নিয়ে চলে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তার মনে হয় এরকম একজনের জন্য মনটা তৃষিত হয়েছিল এতদিন? কি স্নিগ্ধ নদীর মনটা, কি আশ্চর্য ওর উপলব্ধি। নীল অবশ্য জানে ওই ছোট্ট শিশু দুটি নদীর এক ধরনের পরিচয় বহন করে। জীবনের বাস্তবতা বড় কঠিন। কঠিন ঢাকা শহরের জীবনও। তবু নিজেকে সামলাতে পারে না সে। বাসায় ফিরে আসে। ফোন দেয়- নদী ঠিকমত পৌঁছাল কিনা জানতে চায়। সেই শুরু। তারপর প্রতিদিন চলতে থাকে ফেসবুক, হোয়াটসআপ চ্যাট। নদী নীলের কাছে আসে। নীল নদীর দিকে এগিয়ে চলে।

৪.

বইমেলা থেকে ফেরার পথে মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এর আগে গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। এজন্য মর্মান্তিক ওই ঘটনার পর নদী নীলকে সাবধান করে দেয়। প্রতিবাদ সভায় সামনে দাঁড়িয়ে নীল; মিছিলে নীল; টিভির পর্দায় নীল- দেখতে পেয়ে আতঙ্কিত হয় নদী। ফোনে বারবার তাগাদা দেয়। এসব থেকে দূর থাকো। কি করছ? কিন্তু নীল চায় নদীকে এসব প্রতিবাদ সভায় টেনে আনতে। ও অনুরোধ করে। শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশ হয় রবিবারে। রানি আর দীপকে সঙ্গে নিয়ে নদী চলে আসে। ওরা বসে থাকে নীরবে। অসংখ্য মানুষের আনাগোনা আর তারুণ্যের উদ্দীপনা দেখে নদী নীলের আরো কাছে আসে। ধীরে ধীরে বলে কোথায় নিয়ে চলেছ সংসারের মানুষটিকে? আমি কি সামলাতে পারব এতো সব? তোমার পথ চলা কেমন যেন উল্টাপাল্টা। লেখকরা এমন হয় কেন? এই শহরে তোমার মা-বাবা আছেন কিন্তু তুমি একা থাকতে পছন্দ কর। এসব কেন বলত নীল?

সমাবেশের একপাশে বসে যখন ওদের দু’জনের জীবনের হিসাব-নিকাশ চলে তখন প্রকৃতির নানা রঙের মেলাকে সার্থক মনে হয়। সেজে উঠেছে বসন্ত প্রকৃতির রূপ। কিন্তু সেই সুন্দরের মধ্যে অশুভ উগ্রবাদিতার জীবাণুর বিচরণ ওদের মস্তিষ্কে তীব্র দহন সৃষ্টি করে। তারপর সভা শেষে ভেতরে ক্ষোভ আর ভয় নিয়ে মধুর কেন্টিনে এসে বসে। ক্যাম্পাসে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় এই নিরাপদ চত্বরে লেখকদের ওপর হামলা আসে কি করে? নিজের ক্ষুদ্র লেখক সত্তা নিয়ে নীল বিচলিত হয়। ভয় এসে দেহের স্নায়ুকে বিক্ষিপ্ত করে তোলে। নদী তাকে উৎসাহ দেয়- ‘লিখতে হবে নীল। জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লেখার জন্য কাউকে না কাউকে থাকতে হবে। এর আগে আমি তোমার চাকরি আর পরিবারের কথা চিন্তা করে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম আমরা একা নই। অনেকে আছে আমাদের প্রতিবাদের সঙ্গে। ভয় কি নীল?’ নদীর কথাগুলো শুনে শিরার ভেতর রক্ত লাফ দিয়ে ওঠে। এভাবে আদর করে ওকে কেউ এসব কথা বলেনি। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। নদীর ছেলে-মেয়ে দুটোকেও নীলের আপন মনে হয়। টিএসসি থেকে ট্যাক্সি ক্যাবে উঠতে হয় ওদের। বাসার কাছাকাছি পৌঁছে দিতে গিয়ে নীল আজ নদীর হাত স্পর্শ করে। নদী নিজেকে ওর ভেতরে ছেড়ে দেয়। শক্ত করে চেপে ধরে নীলের হাত। ক্যাম্পাসে হাঁটার সময় হাত ধরতে ইচ্ছে করেছিল। কিন্তু নীলের সে কথা বলার সাহস ছিল না। তাছাড়া সেখানে অনেকেই তার পরিচিত।

৫.

গত দশ বছর ধরে নীল পত্রপত্রিকায় কলাম লিখে আসছে। ইতোমধ্যে তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার একটি পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করে সে। তরুণ লিখিয়েদের মধ্যে প্রগতিশীল চেতনা বিস্তারে তার উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেও প্রশংসিত হয়েছে। বিনয়ী, সৎ ও সপ্রতিভ নীল অবিবাহিত কিন্তু পারিবারিক  জীবন থেকে  দূরে। লেখার কাজ আর সামাজিকতার ঝামেলা একসঙ্গে চালাতে না পেরে মা-বাবা ও চার ভাইবোনের সংসার থেকে আলাদা হয়ে একটি ছয় তলার বাসার ছাদে আশ্রয় নিয়েছে সে। বাসাটি ছাদে হওয়ায় আকাশের পূর্ণ ছবির মগ্নতা তার ভেতর কবিত্ব জাগিয়ে তোলে। একাকী থাকে বলে নিজেকে এবং নিজের লেখা নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতে পারে। নদীর সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকে খুব ইচ্ছে হয়েছে ওকে নিয়ে বাসার ছাদে বসে গল্প করতে। জ্যোৎস্না রাত জেগে কাটিয়ে দিতে। নদীর সুন্দর একটা মন আছে। যা সংসারের ভেতরে থেকেও সতেজ; আলো ছড়াচ্ছে পৃথিবীতে। স্বামী ও দু সন্তানের সংসারের দায় মেনে নিয়েও নিজের মতো করে সময় বের করে ও- কবিতা লেখে, গান শোনে। এজন্য নদীকে ভাল লাগে নীলের। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে ওর হাত ধরে। সেদিন হাত ধরার পর নীল আর আগের মতো থাকতে পারে না। একটু দেখার জন্য ছুটে গেছে নদীর বাসার কাছে। নদী কখনো বের হয়েছে; আবার কখনো ওকে সময় দিতে পারবে না জানিয়ে দিয়েছে। স্বামীকে না জানিয়ে অন্যের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া সবসময় সম্ভব হয় না তার। তবু নদী পত্রিকায় লিখতে চায়। নিজের মেধা দিয়ে অন্যের কাছে পরিচিত হতে চায়। নীল ওকে অনেক উৎসাহ দেয়। এজন্য ওর ভাল লাগে তাকে। কিন্তু নীল ভাবাবেগে চলে। খুব বেশি মাখামাখি চায় সে। অন্যদিকে নদীকে আবেগ ও সংসার সামলে চলতে হয়। অনেক সময় নীল জোর করে। নদীকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরতে চায়। কিন্তু নদী সেই সময় দিতে পারে না।

৬.

বর্ষার শুরু থেকেই বৃষ্টির বিরাম নেই। একটানা চলছে শ্রাবণের ধারা। হোয়াটসআপে একটার পর একটা ছবি পাঠাচ্ছিল নদী। শুক্রবারের পর থেকে নীল নদীকে নিবিড়ভাবে পাওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে আগুনের তাতে দগ্ধ হচ্ছে। ওইদিন সিএনজি অটোরিকশায় বাসার দিকে যাবার সময় নদী ওর কাঁধে মাথা রেখেছে। আদর করে আকড়ে ধরেছে নীলের হাত। নীল এতোটাই বিমোহিত হয়ে পড়ে যে গন্তব্যে পৌঁছালেও সে স্বাভাবিক হতে পারে নি। কারণ আগের দিন ভেবেছিল কোনোদিন একসঙ্গে রাস্তায় বের হলে নদীকে কাঁধে মাথা রেখে ঘুমতে বলবে। নির্ভরতা খুঁজে ফেরা নীলের ভেতর নদীর চেতনা ঢুকে যায়। সেদিন দুজনের ভাবনার অলিখিত মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়। পরেরদিন নীল অপেক্ষা করে তার বাসায় নদী আসবে। ওরা দুজনে ছাদে ঘুরেফিরে বৃষ্টিতে ভিজবে। আর নিজেদের ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে শরীরের উষ্ণতা নিয়ে সারাদিন কাটাবে। কিন্তু নীলের সেই আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থেকে যায়। নদী ঠিকই এসেছিল; বসেছিল নীলের বুকে মাথা রেখে। সেটা ছিল সান্ত্বনা খুঁজে ফেরা নিরাশ্রয় এক নারীর কাতরতা। ওর স্বামী অন্য মেয়ের প্রেমে পড়েছে। নদীকে ঠিকমতো সময় দেয় না। কথায় কথায় বলে ‘তুমি চলে যাও’। স্বামীর আচরণ ওর মনকে বিষিয়ে তুলেছে। রাগে, দুঃখে বাচ্চাদের ফেলে বাসা ছাড়ে নদী। রাস্তায় বের হয়ে প্রথমেই তার নীলের কথা মনে পড়ে। বিয়েটা করার পর নদীর বাবা-মা আফসোস করেছিল কার সাথে বিয়ে হলো একমাত্র আদরের কন্যার? কিন্তু নদী মেনে নিয়েছিল। সমঝোতা, সহনশীলতায় নিজেকে তৈরি করেছিল। হঠাৎ কি হলো অনিলের? যৌন বাতিকে পরিণত হয়েছে সে। রাতদিন খারাপ চিন্তা। নদী চলে গেলেই যেন বাঁচে। কোথায় যাচ্ছে নদী? কি করছে? কার সাথে ফেসবুকে কথা বলছে ইত্যাদি নিয়ে আবার মাথাও ঘামায় সে। এতোদিন নদী সবকিছু ধৈর্য ধরে সহ্য করলেও নীলের সঙ্গে পরিচয়ের পর ও অনেকটাই বদলে গেছে। কিন্তু সারাদিন নীলের বুকে শুয়ে থেকেও সন্ধ্যায় শিশু দুটির কথা ভেবে তাকে নিজের বাসায় ফিরতে হয়। তাছাড়া নীলের সঙ্গে থাকার সময় ও টের পেয়েছে কারা যেন কিছুক্ষণ পরপর নীলকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। নীল ইদানিং বড্ড বেশি উগ্রবাদি রাজনীতির বিরুদ্ধে কলাম লিখছে। তার আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী ওর পিছু নিয়েছে। নীলের বাসা থেকে বের হয়ে নদীর খুব নিজেকে অসহায় মনে হয়। নীলের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। নদীর নিজের আশ্রয়টা ভাঙতে শুরু করেছে। নিজের একটা চাকরি এখনো হয়নি। বাঁচানোর মতো ক্ষমতা থাকলে নীলকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেত। পর নারী আর মদ নিয়ে সময় কাটালেও আবার সেই অনিলের সঙ্গে আপস করতে হবে? হায়রে নদীর জীবন?     

৭.

বারবার প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে কয়েকদিন ধরে নীলের মনের ভেতর অজানা শঙ্কা ঢুকেছে। ব্লগার অভিজিতের হত্যাকারী ধরা পড়েছে, হায়দার, রাজীবসহ আরো কয়েকজনের হন্তারকরা এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ওকে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। সাবধানে চলা উচিত ওর। কিন্তু সবসময় বন্ধুদের নিয়ে চলা তার স্বভাববিরুদ্ধ। তাছাড়া নদীর সঙ্গে সম্পর্কের কথা ও কাউকে জানায়নি। ওর পক্ষে একা থাকা আনন্দের, একা চলা সুখের। সেদিন নদী ওকে এয়ারপোর্ট রোডের বেঙ্গল অফিসের পাশে আসতে বলে। জায়গাটি সুন্দর। ব্যস্ত সড়কের ধারে একটি কাবাব হাউজ। সবুজ গাছগুলো দলবদ্ধ; ওরা জেগে থাকে; মানুষের গোপন কথা শোনে আর ব্যাকুল হয় প্রকাশের ইচ্ছে নিয়ে। নদী আজ আকাশনীলা শাড়ি পড়েছে। জারুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল নীল। দূর থেকে নদীকে দেখে এগিয়ে যায়। হাত ধরে। পৃথিবীর সব সংকটকে, সব আশঙ্কাকে তার তুচ্ছ মনে হয়। নদী তার পরম নির্ভরতার আঙিনা হয়ে ওঠে। দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে। এদিকে মানুষের আনাগোনা কম। একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় নদী। চোখ রাখে নীলের চোখে। আপ্লুত নীল জড়িয়ে ধরে নদীকে। নদী সামলে নিয়ে ওকে ছাড়িয়ে দেয়। নীল ছিটকে যায়। বিমর্ষতা তার চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। নদী বলে, ‘আবার সেই দেহ। দেহটা… তোমাকে কতবার বলতে হবে।’… দুজনে চুপ। হয়তো আরো কিছুক্ষণ এভাবে চলত। কিন্তু কৃষ্ণচূড়া গাছে একজোড়া ঘুঘু এসে বসে। ডাক শুনে ওদের চোখ চলে যায় সেদিকে। পাখি দুটি একে অপরকে ঠোঁট দিয়ে আদর করে, মুখ লুকায় একে অপরের পালকের গভীরে। নদী একবার ওদের দিকে, একবার নীলের দিকে তাকায়। কাছে এসে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে রাখে ঠোঁট। নিবিড় করে আলিঙ্গনে জড়ায় নীলকে। অভিভূত নীল নিজের ভেতর প্রবল শক্তি পায়। নির্ভার মনে হয় নিজেকে। আশ্চর্য এক জলের রেখা তরঙ্গের দোলা দিয়ে সারা শরীরকে মথিত করে তোলে। নদী ওর হাতের ভেতর হাত চেপে ফিস-ফিস করে- ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি।’এ কথা কতবার শুনেছে সে। কতবার নদী তাকে ফেসবুক, হোয়াটসআপে পাঠিয়েছে। কিন্তু আজকের এই বিকেল অন্যরকম মনে হয়। রাস্তার গাড়িগুলো সাদা মেঘ হয়ে ওঠে। যেন ওদের চারিদিকে আকাশের বিস্তার। শ্রাবণের মেঘ সেখানে মুখর হয়ে ভাসছে। নীলের জীবনে নদীর সঙ্গে সম্পর্কের এ এক আশ্চর্য বন্ধন। দেহের চেয়ে যেখানে মনের বাঁধন তীব্র। কখনো তার মনে হয়নি দেহহীন প্রেম সম্ভব। কিন্তু নদীর স্নিগ্ধ চোখের চাহনি ওকে বারবার ক্ষত-বিক্ষত করেছে। ওর চোখের শাসন আর সোহাগ নীলকে দূরে যেতে দেয়নি।

৮.

এয়ারপোর্ট রোডে সন্ধ্যা নেমে আসে হৈচৈ করে। প্রচণ্ড শব্দ করে দূরের মহাদেশে ছুটে চলে বিচিত্র বর্ণের বিভিন্ন ওজনের বিমান। নদীকে বাসার কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে নীল ফিরছে একা। যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে তার রিকশা এগিয়ে চলেছে রামপুরার দিকে। আবার বৃষ্টি নামল। ঝিরঝির বৃষ্টি মেখে ইছামতির স্রোত ভালোবেসে নদীর গ্রামে গিয়ে ওর সঙ্গে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর দিনটির কথা মনে পড়ে। সেদিন নদী কিশোরী হয়ে উঠেছিল। বারবার কাছে এসে ধাক্কা দিয়ে বলছিল- ‘দেখ ওইদিকটা আমরা সাঁতার কেটে পার হতাম। দেখ ওই যে মাছরাঙা আমার প্রিয় পাখি। খুব ভালোবাসি। নীলকে যেমন। এই সুবল দা একটু আস্তে চালাও। আমরা অনেকক্ষণ ঘুরব।’ কি যে তার কথার ফুলঝুরি। একের পর একটা গল্প। তার বাড়ির গল্প। তার বাল্যকালের গল্প। আম পারতে গিয়ে টিনের চাল থেকে তার পড়ে যাওয়া। গল্প আর শেষ হয় না। সেদিনও স্নিগ্ধ সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। বিদায় দিয়ে ঢাকায় রওনা দিতে হয় নীলকে। বাসে বসে নদীর চোখ-মুখের অভিব্যক্তিগুলো ঘুরেফিরে মনে আসছিল। আজও তেমনি। নীলের কোনোদিকে মনোযোগ নেই। রিকশা কোন দিকে যাচ্ছে তারও। দেহমনের সবটাই জুড়ে আছে নদী।

হঠাৎ ঘটনাটা ঘটে। তিনজন ওর হুট নামানো রিকশাটা ঘিরে ধরে। একজন বলে ‘এই সে। মার শালাকে। ব্লগারের দোস্ত এইটা। মার।’ ধারাল অস্ত্রের তীব্র আঘাতে কিছুক্ষণের মধ্যে লুটিয়ে পড়ে নীল। ওর জ্ঞান থাকার মুহূর্তে মনে পড়ে কিছুদিন আগে রামপুরা থেকে জঙ্গিগোষ্ঠীর একদল সদস্যকে র‌্যাব গ্রেফতার করেছে। তাহলে তারা এখনো নির্মূল হয়নি, এভাবে সক্রিয়। অবাক বিস্ময়ে সে দেখে মৃত্যুদূতরা ছুটে চলে যাচ্ছে। রিকশাওয়ালা চিৎকার করছে। মানুষ দেখছে কিছু করছে না। আকাশের উপর দিয়ে তখন বুনোহাঁসের একটি দল এই শ্রাবণের মুখর সন্ধ্যায় প্রশান্ত পাখনায় ভেসে চলেছে। এয়ারপোর্ট ছেড়ে পশ্চিম দিকে উঠে একটি বিমান রুট অনুসরণ করে দক্ষিণে চলে যাচ্ছে। বিমানটির শব্দে নীলের আর্তনাদ চাপা পড়ে যায়।

৯.

নদী বাসায় ফিরে শাড়ি খুলতে খুলতে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। আজ বিকেলটা সুন্দর কেটেছে তার। কিন্তু নীলকে সে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে না দিলেও পারত। পরে অবশ্য নীলকে আদর করেছে। নদীর মনে হয় নীল আদরের কাঙাল। একটু  স্নেহ পেলে গলে যায়। হাত ধরে কাছে টেনে নিলে পৃথিবীর সব দুঃখ ভুলে যায়। ও একটা অদ্ভুত ছেলে। কি যে আবোলতাবোল কাজ করে না। বড় অস্থির মনে হয় ওকে। আজকে কি যেন ভাবছিল। হঠাৎ হঠাৎ আনমনা হচ্ছিল। কি যে ও বলে। আমার একদম ভাল লাগে না। কিসব হত্যা, জঙ্গিনিধন, জটিল সব রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায়। সাহস দেখিয়ে কি লাভ ওর? প্রথম দিকে ভরসা দিয়েছি। এখন যেন আমার নিজেরই সাহস হারিয়ে গেছে। কেবল ভাবি আমার ছোট ঘরের সংসার ভাল। স্বামী-বাচ্চা নিয়ে বেঁচে থাকা ভাল। ওসব জটিল জীবন আমার নয়। কিন্তু ওকে ছাড়তে পারি না কেন? ও বারবার টেনে নিয়ে যায়। ভেঙে ফেলে সব। এতো আপন মনে হয় কেন ওকে।

রান্না করে রেস্ট নিচ্ছিল নদী। ১০টা বাজতে এলো। স্বামী ফিরেছে। খবর শোনার জন্য টিভি অন করে সে। আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে বাচ্চাদের নিয়ে। কি যে চঞ্চল হয়েছে ছেলেটা; শুধু মোবাইল ঘাটাঘাটি। ‘এই, এদিকে আয়। বস চুপ করে। খবর শুনতে দে।’ ধমক খেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রানি ও দীপ। হঠাৎ অবাক হয়ে ঝুঁকে পড়ে নদী। একি নীলকে খুন করা হয়েছে। হাসপাতালে লোকে-লোকারণ্য। পেট ফেরে চাকু চলে গেছে। বের করতে পারেনি ডাক্তাররা। তার আগেই ওর মৃত্যু ঘটেছে। নদী কি করবে বুঝতে পারে না। ভাবে এক্ষুণি বের হবে সে? সব এলোমেলো হয়ে যায়। ওর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অনিল এগিয়ে এসে কর্কশ কণ্ঠে বলে- কি হয়েছে? তোমার শরীর খারাপ কেন? নদী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ও উঠে দাঁড়াতে চায়, পারে না, বসতে চায় কিন্তু তার আগে কোথা থেকে দমকা হাওয়া দিয়ে ঘরের ভেতর একরাশ নীল আলো ঢুকে পড়ে। প্রচণ্ড শব্দ করে ওদের বিল্ডিংটার ওপর দিয়ে বোয়িং ৭৭৭ পূর্ব দিকে চলে যায়।

নদীর মনে হয় নীল ওই বিমানটার সাথে আকাশে বিলীন হয়ে গেল। ওকে আর ধরা যাবে না। বিছানায় ছিটকে পড়ে সমস্ত শরীর ঝাকুনি দিয়ে মর্মভেদী আর্তনাদ করে ওঠে নদী। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রানি আর দীপ।                         

    (২০১৫ সালের দৈনিক যায় যায় দিন পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর